এই একুশ শতকে এসেও অপারেশন ক্লিনহার্টের মাধ্যমে যে সব অন্যায় করা হয়েছে, সেগুলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা অপরাধ করছে তারা বহাল তবিয়তে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোন হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পেরেছি আমরা? এই বিচার-প্রক্রিয়া চালাতে গিয়েও তো কত বাধা ডিঙাতে হয়েছে! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য যারা এ দেশে খুন-হত্যার সংস্কৃতি চালু রাখতে চায়, তারা এই হত্যার বিচার হোক তা চায়নি।
এই যে একটি সংস্কৃতি, এর ফলেই গ্রেনেড-হামলার মতো ঘটনা ঘটে। বিএনপি বা মৌলবাদী গোষ্ঠী যারাই কাজটা করেছে– তারা ভেবেছে, তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা যদি খুন হয়ে যান তাহলে ওদের সুবিধা হবে। ওরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে। আর ওরা এটাও বুঝতে পেরেছে যে, ওদের বিচার হবে না বরং পুরষ্কৃত হবে। ওরা দেখেছে এটাই হয়ে এসেছে। তখনকার সরকার যে গ্রেনেড-হামলার ঘটনায় সত্যিকারের অপরাধীদের ছাড় দিয়েছিল, সেটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।
আমার প্রশ্ন হল, গত চার বছরে আওয়ামী লীগ সরকারই-বা কী করতে পেরেছে? গ্রেনেড-হামলা মামলার বিচার শেষ হতে তো এত সময় লাগার কথা নয়! রাজনীতিবিদরা, মন্ত্রীরা বলেন– হচ্ছে, বিচার করা হবে– কিন্তু তার জন্য কতদিন লাগবে?
‘এস্টাব্লিশমেন্ট’ নামে একটা শক্তি আছে। যে দলই ক্ষমতায় যায় সে এই শক্তির কাছে পরাভূত হয়। সে এই শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সমাজে-রাষ্ট্রে-প্রশাসনে-রাজনীতিতে সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে দলমতনির্বিশেষে একটি ঐক্য থাকে। এরা রাষ্ট্রে সুশাসন ও সুবিচারের পরিপন্থী কাজ করার জন্য সব সময় সক্রিয় থাকে। ফলে বিরোধী দলে থাকার সময় একটি দল যা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় গেলে ওই শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যায় বলে কিছুই করতে পারে না।
ওই এস্টাব্লিশমেন্টের কাছে পরাভূত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারও বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিনাশ করতে পারছে না। এটা না করতে পারলে কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হব।
একুশে আগস্টের গ্রেনেড-হামলার পেছনে একটি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী জড়িত ছিল বলেই স্পষ্ট। কারণ, এরা শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিপজ্জনক মনে করে। প্রশ্ন হল, ক্ষমতায় যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গিবাদের ব্যাপারে কী ভাবছে, কী করছে? জঙ্গিবাদ নির্মূলে আমরা আপাতদৃষ্টিতে সফল হয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। আসলে কি তাই?
চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই দেখা যাবে, এরা নতুন নতুন আকার ও চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। আমি খুব দুঃখ পেয়েছি একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সঙ্গে ছিল যে মুদাসসরীনরা– তাদের অনুরোধে সরকার আরবি বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলে সেটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। কারণ তাতে মাদ্রাসাগুলো আরও শক্তিশালী হবে। নতুন রূপে নতুনভাবে জঙ্গিবাদের বিশাল উত্থান হবে।
আমি তাই মনে করি, এ দেশে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজ-পর্যায়ের শিক্ষাকে দুর্বল করে ফেলছি, এদিকে মনোযোগ দিচ্ছি না। তাতে সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সুযোগটা প্রসারিত হতে যাচ্ছে। আমরাই কিন্তু সুযোগগুলো ওদের হাতে তুলে দিচ্ছি। ওরা সে সব সুযোগ নিয়ে বিভিন্নভাবে অগ্রসর হতে যাচ্ছে। এই শক্তি আবারও বিপজ্জনক ও অগণতান্ত্রিক একটি শক্তি হিসেবে বিকশিত হবে।
আরেকটি দুঃখের বিষয়, আমাদের কলেজগুলোতে এখন ইতিহাস পাঠ্য নয়। ওদিকে ইসলামের ইতিহাস ঠিকই পড়ানো হচ্ছে। আমি নিজে এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, ব্যবস্থা হচ্ছে, কিন্তু কবে?
সারা বিশ্বে ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক, এমনকি উচ্চতর পর্যায়ে মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়ে পড়তে গেলেও ইতিহাস পড়তে হয়। পাকিস্তানের কলেজগুলোতে ইতিহাস পাঠ্য নয়। এটা তুলে দিয়ে পাকিস্তান স্টাডিজ পড়ানো হচ্ছে। আমাদের কলেজগুলোতে পাকিস্তানের আদলে বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়ানো হচ্ছে। তাহলে এক সময় আমাদের ছেলেমেয়েরা জানবে না মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। তখন তারা প্রশ্ন করতেই পারে, ‘কেন গোলাম আযমের মতো একজন মুসল্লিকে অপদস্থ করা হচ্ছে! কেন তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে!’
আরেকটি সমস্যা হতে যাচ্ছে ভর্তিপরীক্ষাগুলো উঠিয়ে দেওয়ায়। এখনকার নিয়মে উচ্চতর পর্যায়ে ভর্তির মূল পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসির মোট নম্বর ৬০ ধরা হয়। এরপর এর মধ্যে শিক্ষার্থী কত পেল তা হিসাব করা হয়। বাকি ৪০ নম্বর শিক্ষার্থী ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে পায়। দেখা যায়, মাদ্রাসা বোর্ডগুলোতে ইচ্ছে করেই শিক্ষার্থীদের ৯০ বা ১০০ করে নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়। তাতে ওরা ওই ৬০ নম্বরের পুরোটাই পেয়ে যায়।
সেক্যুলার শিক্ষায় তো অত নম্বর পাওয়ার সুযোগ নেই। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ৬০ কী ৭০ পায়। তাতে ওরা ৬০ নম্বরের মধ্যে বড়জোর ৫০ পেল। এখন ভর্তিপরীক্ষায় দুজনেই যদি ২০ করে পায় তবে যে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল থেকে ৬০ পেয়েছে তার মোট নম্বর হয় ৮০। আর যে ৫০ পেয়েছে তার হয় ৭০। এই পদ্ধতির ফলে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে ভর্তি হচ্ছে। সেক্যুলার ধারারা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে। এর ফলাফল ভয়াবহ হতে বাধ্য।
সে জন্যই আমি আশঙ্কা করছি– এখন যে মেডিকেলে ভর্তিপরীক্ষা তুলে দেওয়া হচ্ছে তার ফলও খারাপ হবে। মাদ্রাসা-শিক্ষার্থীরাই মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে। সরকার কোচিং-ব্যবসা বন্ধ করার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। কোচিং-ব্যবসা বন্ধ করা প্রশাসনের জন্য কোনো ব্যাপার নয়। কথা হচ্ছে সরকার এ ব্যবসা বন্ধ করতে চায় কি না। কারণ এখানে তো শুধু জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কোচিং সেন্টারগুলোই ব্যবসা করছে না– সরকারি লোকদের সহযোগিতায়ও কোচিং-ব্যবসা চলছে। এই ব্যবসা বন্ধ করার ক্ষমতা সরকারের নেই।
এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এ সব বিষয়ে বলতে গেলে তারা বাস্তব পরিস্থিতির কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু মৌলবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন– এরা করতে চান না। আমি মনে করি, এ দেশে জামায়াত যতদিন রাজনীতিতে সক্রিয় থাকবে ততদিন খুন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু থাকবে। বিএনপি যতদিন রাজনীতিতে শক্তিশালী থাকবে ততদিন এই সংস্কৃতি পরিপুষ্ট হবে। কারণ, খুনের মাধ্যমেই বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। একাত্তরে বাঙালি-নিধনের মাধ্যমে জামায়াতের শেকড় শক্ত হয়েছে। আমরা কেন পারছি না দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জন্য দায়ী নাজি ও ফ্যাসিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করার উদাহরণ দেখে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে?
যুদ্ধাপরাধের সঠিক বিচার হলে গণতান্ত্রিক শক্তি একটা সাহস পেতেন। কিন্তু এই বিচার সরকার যেভাবে করছেন তাতে আমাদের আপত্তি আছে। আমরা চেয়েছিলাম, সরকার অবকাঠামোগত সাহায্য নিয়ে বিচার-প্রক্রিয়াটি শক্তিশালী করুক। সমস্যা হচ্ছে, এখন এ নিয়ে কথা বললে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে। যারা বলছে তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে।
এ সব কারণেই আমার মনে হয় আমাদের বিপদ শুরু হচ্ছে। আমরা যেভাবে ভেবেছিলাম– এই সরকার ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে এসে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ঠেকানোর জন্য কঠোর উদ্যোগ নেবে। ওদের বিকশিত হওয়ার জন্য সুযোগ করে দেওয়া তো দূূরের কথা– ওদের বিনাশ করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নেবে। এই সরকার হবে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রহরী এটাই আমাদের চাওয়া ছিল। সরকার সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের জন্য কাজ করবে, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত ও যুগোপযোগী করবে– আমাদের আস্থার জায়গাটা ছিল ওখানে।
দুঃখের সঙ্গেই বলছি এই সরকার তা হতে পারেনি। সরকারের মন্ত্রীদের প্রসঙ্গে বলব– অনেকেরই কোনো ভিশন নেই– আছে প্রচুর টাকা আর দেশের বাইরে যাওয়ার ভিসা– থাকার জন্য বাড়ি। তাই আমি একবার লিখেছিলাম, ‘যারা মন্ত্রী হন তারা আর শিক্ষিত থাকেন না। তাদের বোধশক্তি কমে যায়!’
বুদ্ধিজীবীদেরও একটি অংশ– তা তারা সাংবাদিক হোন কী লেখক বা অন্য পেশার– সত্য কথাগুলো নির্বিঘ্নে দুঃসাহসের সঙ্গে বলতে চান না। কারণ এখানে নানা হিসাব কাজ করে। সবাই স্বার্থের বেড়াজালে বন্দী।
কথা হল, এ থেকে কি মুক্তির কোনো উপায় নেই? আছে। ওই যে পদক্ষেপগুলোর কথা বললাম সেগুলো সমন্বিতভাবে নিতে হবে। বিচারহীনতা ও খুনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পঁচাত্তরে চার নেতা হত্যার বিচারও খুব জরুরি। এর সঙ্গে ২০০৪ সালের গ্রেনেড-হামলা মামলার বিচার খুব শিগগির করতে হবে। তাতে মৌলবাদীদের দেখিয়ে দেওয়া যাবে যে তারা সহজেই পার পাবে না।
পাশাপশি আমি বলব, মামলার বিচার হলেই কিন্তু সব শেষ হযে যাবে না। নতুন রূপে জঙ্গিবাদ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে তাদের ঠেকাতে হবে। এ জন্য ওদের হাতে সুযোগগুলো তুলে দেওয়া তো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সে সঙ্গে এ দেশের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সমর্থন ও পরামর্শ মেনে কাজ করতে হবে।
ক্ষমতায় যাওয়ার আগে প্রতিপক্ষকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলবেন। আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর নিজেরাই সে শিক্ষা নেবেন না তা হয় না।